নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - অর্থনীতি - উৎপাদন ও সংগঠন | NCTB BOOK

আয়েশা বেগম তাঁর সংসারের যাবতীয় কাজের ফাঁকে বাড়িতে একটি হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন । এই খামার থেকে সারা বছরই কমবেশি ডিম উৎপাদিত হয়। এক বছর পর সরকারি মাছের খামার দেখতে যান আয়েশা এবং এর পর থেকে তাঁর মাথায় হাঁস-মুরগির খামারের পাশাপাশি মাছ চাষ করার আগ্রহ জাগে। এক বছরে হাঁস-মুরগির খামার থেকে ডিম বিক্রির নিট আয় বিশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি বাড়ির পাশে ২ বিঘা জমিতে পুকুর করে বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ শুরু করেন । দুটি খামারে নতুন করে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ পায় । হাঁস-মুরগির খামার থেকে ডিম বিক্রি এবং এক বছর পরে পুকুরের মাছ বিক্রি শুরু হলে আয়েশার উপার্জন বাড়তে থাকে । তিনজন সন্তানের পড়াশোনার খরচ এবং সংসারের অন্যান্য যাবতীয় খরচ মিটিয়ে আয়েশার সঞ্চয়ও বাড়তে থাকে । আয়েশার মাছ ও হাঁস-মুরগির খামারের কাজকর্ম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর স্বামী রহমত আলী শহরের চাকরি ত্যাগ করে গ্রামে স্ত্রীর খামারে যোগ দেন। উভয়ের প্রচেষ্টায় তাঁরা বেশ কিছু জমি, হাঁস-মুরগি এবং মাছ চাষের আওতায় নিয়ে আসেন । ১২ জন নারী-পুরুষ শ্রমিকও নিয়োগ করেন । প্রত্যেক শ্রমিকের কাজও বুঝিয়ে দেন তাঁরা। আয়েশা এবং রহমত পালাক্রমে শ্রমিক কর্মচারী এবং খামারসমূহ তদারক করেন । ডিম ও মাছ বাজারজাত করে বেচা-কেনার ব্যবস্থাও করেন তাঁরা । তাদের সাফল্য দেখে গ্রামের অনেকে তাঁদের অনুসরণ করে গ্রাম ও এলাকা জুড়ে হাঁস-মুরগির খামার এবং মাছ চাষ শুরু করেন । ডিম ও মাছ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার নিয়মিত আসে আয়েশার গ্রামে । কয়েক বছরে এলাকাটি কৃষি, হাঁস-মুরগির খামার ও মাছ চাষাবাদ করে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে । এলাকায় এখন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হাঁস-মুরগি ও মাছ উৎপাদন করা যায় ।

 

আমরা কি বলতে পারি যে আয়েশা বেগম একজন সংগঠক? তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা কি বিকাশ লাভ করেছে?


উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিশ্চিত যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করাকে সংগঠন বলে । সত্যিকার অর্থে সংগঠন ছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা প্রায় অসম্ভব। আধুনিক বিশ্বে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন জন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন । এ দায়িত্ব সংগঠক দক্ষতার সাথে যোগ্যতা অনুযায়ী ভাগ করে দেন । এভাবে কর্মীদের সহায়তায় উৎপাদন ও ব্যবসায়ের বিভিন্ন কার্যবলি সম্পাদিত হয়। কিন্তু এই কার্য সম্পাদনে কর্মীদের মধ্যে একটি পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক এই অধিকার ও দায়িত্ব কাঠামোই সংগঠন । সুতরাং সংগঠন হচ্ছে ব্যবসায়ের ভিত্তি ।


সংগঠনের বিভিন্ন অংশ একসঙ্গে ধরে রাখা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় রূপরেখা তৈরি সাংগঠনিক কাঠামোর কাজ । তাছাড়া বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব বণ্টন, নিয়ম-শৃঙ্খলা গড়ে তোলা ইত্যাদি সাংগঠনিক কাঠামোর অন্তর্গত । ব্যবসায়ের আয়তন, উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ, শিল্পের প্রকৃতি, উৎপাদন প্রক্রিয়া, শ্রমিকের দক্ষতা প্রভৃতির উপর ব্যবসায়ের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ভরশীল । সংগঠনের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সম্মিলিত উৎপাদন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উৎপাদনের বা আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। তা না হলে কোনো সামাজিক সংগঠনই টেকসই হয় না ।
ব্যবসায়ের সাংগঠনিক কাঠামোর বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ ও শাখার কাজকর্ম নির্দিষ্ট করে ভারপ্রাপ্ত উর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মীদের পদগুলো ক্রমানুসারে সাজালে তা হতে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কাঠামোর যে সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় তাকে সংগঠনের চিত্র বলে। সংগঠন ব্যবস্থাপনা যত সুন্দর ও সুষ্ঠু হবে ব্যবসায়ের সাফল্য তত বেশি হবে । সুতরাং সংগঠনই হলো ব্যবসায়ের বা যে কোন সামাজিক উৎপাদনের মৌলিক ও প্রধান বিষয় । কাজ : সাংগঠনিক কাজের একটি তালিকা তৈরি কর ।
একটি ভালো সংগঠনের কতগুলো প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্য থাকে । তা হচ্ছে-


১. ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি : সংগঠনের প্রথম ধাপে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য কী হবে তা নির্ধারণ করতে হয় । ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি অনুসারে ব্যবসায়ের সাংগঠনিক রূপ তৈরি করতে হয় । এই উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে কোনটি মুখ্য, কোনটি গৌণ, কোনটি স্বল্পমেয়াদি এবং কোনটি দীর্ঘমেয়াদি তা নির্ধারণ করে নিতে হয় ।


২. ব্যবসায়ের কার্যাবলি নির্ধারণ : ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ঠিকমতো নির্ধারণ করার পর ব্যবসায়ের সমগ্র কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা হয় । যেমন, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, অর্থসংস্থান, শ্রমিক-কর্মী নিয়োগ, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক প্রভৃতি। সে জন্য প্রয়োজন হয় হিসাবরক্ষণ, বিজ্ঞাপন ও প্রচার, পণ্য মজুদ, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।

৩. কার্যাবলির বিভাগ : কার্যাবলি বিশ্লেষণের পর কাজের ধরন ও উদ্দেশ্যের মিল অনুযায়ী কাজগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। একই বিভাগের সহায়ক কাজগুলোকে আবার উপবিভাগে ভাগ করা হয় । যেমন, উৎপাদন বিভাগ, ক্রয় বিভাগ, বিক্রয় বিভাগ, হিসাবরক্ষণ বিভাগ, প্রচার বিভাগ ইত্যাদি । অনেক সময় কোনো কোনো ব্যবসা আঞ্চলিক ভিত্তিতেও ভাগ করা হয় । কয়েকটি শাখা একত্রে আঞ্চলিক বিভাগ হিসাবে গণ্য হয় ।


৪. কর্তব্য বণ্টন : ব্যবসায়ের প্রতিটি কর্মীর উপর একটি নির্দিষ্ট কাজের ভার অর্পণ করা হয় । অভিজ্ঞতা, ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুসারে প্রতিটি বিভাগে ও উপবিভাগের প্রতিটি কর্মীর সুনির্দিষ্ট কর্তব্য স্থির করা হয় এবং যে কর্মী যে কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ, তাকে সেই কাজই দেওয়া হয় ।


৫. অধিকার ও ভার বণ্টন : ভার অর্পণ বলতে কর্তব্য পালনের উপযুক্ত কার্যনির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করাকে বোঝায় । প্রতিটি কর্মীকে স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে এবং যথাযথভাবে কাজ করার অধিকার দিতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার একাংশ তাঁর অধস্তন কর্মীকে অর্পণ করেন । আবার অধস্তন কর্মী তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট কাজের কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকেন। উপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে উপরে এই দুটি ভিন্নমুখী প্রবাহ অব্যাহত থাকলে সংগঠন সফল হয়।

আরও দেখুন...

Promotion